কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

আজ রোহিঙ্গা সংকট পাঁচ বছর

পাঁচ বছরে উখিয়া থানায় ১৮৯ টি মামলায় ৪শ জন রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক::

মিয়ানমারে সৃষ্টি সহিংসতায় গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। এই পাঁচ বছরে উখিয়া থানায় ১৮৯ টি মামলায় ৪শ জন রোহিঙ্গা আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷

সংকট কালে কয়েক দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিলেও নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা ফেরত যায়নি। ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পডেছে।

কিন্তু পাঁচ বছর পার হলেও তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনো লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরে খুনোখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানবপাচারসহ একাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত কক্সবাজারের উখিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা অপরাধীরা।

এছাড়া রোহিঙ্গারা আসার পর উখিয়ার শ্রমবাজারও বদলে গেছে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তারা নানা ধরনের কাজ করছেন। ফলে স্থানীয় বাংলাদেশিদের জন্য এখন কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাঙালিদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের শ্রম সস্তা।

স্থানীয়দের অভিযোগ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা থেকে খাদ্য এবং নানা ধরণের সহায়তা পাচ্ছে। ফলে কম দামে শ্রম দিলেও তাদের অসুবিধা নেই। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা যেহেতু কোনো সহায়তা পায় না। সে জন্য শ্রমের টাকাই তাদের মূল উপার্জন।

মানবিক কারণে তাদের জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা হলেও রোহিঙ্গাদের এভাবে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা আশঙ্কা। বিপাকে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই।

উখিয়া থানা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধে মোট ১৮৯ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪শ জন আসামি।

তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, এ ৫ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ৯২ টি, হত্যা মামলা ৭৬ টি, ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা হয়েছে ২১ টি। এ ৫ বছরের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে ৭৪ টি।

এছাড়া বিভিন্ন অভিযানে বিপুল পরিমানে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে দেশীয় পিস্তল ১১, বিদেশী পিস্তল ৩টি, এলজি ২৫, একনলা বন্দুক ২৮টি, পাইপ গান ৭টি, ওয়ান শুটার গান ২৫টি ,ম্যাগাজিন ৭টি, কুড়াল ১টি, চাপাতি ২৮টি ,রামদা ৪৭টি , কিরিচ ১৩টি , চুরি ২১টি, কার্তুজ ১১৩টি, গুলি ৫৭১, রাইফেল ১টি।

পাঁচ বছর পার হলেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাবার লক্ষণ দেখছেন না স্থানীয় জনগন।রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় আতংকিত হয়ে পড়ছেন তারা।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, পুলিশ সুপারের নির্দেশে উখিয়া থানা পুলিশ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধী আটক কার্যক্রম জোরদার করে স্থানীয়দের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।

উখিয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রতন কান্তি দে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘ হলে সামাজিকসহ নানাভাবে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়।

উখিয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় রোহিঙ্গারা নানা অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিয়ে করে বাংলাদেশিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ততই বাড়ছে। এর মধ্যে ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) অন্তত সাত-আটটি গ্রুপ সক্রিয়। এতে মিয়ানমারের ইন্ধনও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহযোগিতাও করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই তারা অর্থ উপার্জন এবং বিভিন্ন অপরাধে ঝুঁকে পড়ছে। দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার। না হলে তাদের ভাসানচর বা অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। অবাধে যেন তারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে ব্যাপারে কড়াকড়ি করতে হবে। প্রয়োজনে ক্যাম্পে শক্ত বেড়া দিতে হবে। না হয় দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার এবং আশপাশের এলাকাগুলো নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরদিন বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ও একটি আলোচনা সভায় তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় ও সঠিক পন্থায় না হলে তারা আবারও ফেরত চলে আসবে। মিশেল মনে করেন, এখনো রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে চায়, তবে এটি হতে হবে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ পরিবেশে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সেখানে তাদের ফেরত যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। আমরা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে আসছি। ’

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে মিশেল ব্যাচেলেট আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে সে প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ আছে। এছাড়া মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই সংকটপূর্ণ। সেখানে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে, অনেক সংঘাত চলছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আপনি যদি প্রত্যাবাসনের কথা চিন্তা করেন, তবে সেটি হতে হবে সঠিক পন্থায়। তা না হলে রোহিঙ্গারা আবারও ফেরত চলে আসবে।’

পাঠকের মতামত: